শ্রী মাতাজী

শ্রী মাতাজী

এক কর্মবহুল জীবনকাহিনী

সারা বিশ্ব জুড়ে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে মহানগর পর্যন্ত অবিরাম ভ্রমণ করে শ্রী মাতাজী আত্মসাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রকৃত আধ্যাত্মিক জাগরণের অভিজ্ঞতা লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। এইভাবে তাদের আভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরের উন্নয়ন সাধনের পথ প্রশস্ত করে তিনি সমগ্র জীবন মানব কল্যাণে নিয়োজিত করেন।

শ্রী মাতাজী নির্মলা দেবী, যিনি ডঃ নির্মলা শ্রীবাস্তব নামতেও পরিচিত, ১৯২৩ সালের ২১শে মার্চ মহাবিষুব সংক্রান্তির দ্বিপ্রহরে ভারতের ছিন্দওয়ারা শহরে একটি খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতা ও পিতা কর্নেলিয়া ও প্রসাদ রাও সালভে, তাঁর নাম দেন "নির্মলা", যার অর্থ "নিষ্কলঙ্ক"। তাঁর পিতা ছিলেন একজন আইনজীবী এবং ১৪টি ভাষায় পারদর্শী। তিনি হিন্দিতে কোরআন অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর মা ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা, যিনি গণিতে সাম্মানিক স্নাতক উপাধি লাভ করেন।

শ্রী মাতাজী খুবই অল্প বয়স থেকে তাঁর চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। যখন তাঁর বাবা-মা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছিলেন, তখন শ্রী মাতাজী ঐ বয়স থেকেই পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। মহাত্মা গান্ধী, যাঁর আশ্রমে ছোটবেলায় তিনি প্রায়শই যেতেন, তিনি শ্রী মাতাজীর মধ্যে থাকা বিশেষ আধ্যাত্মিক সত্ত্বাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। গান্ধীজী প্রায়ই আশ্রমের দৈনিক প্রার্থনার বিষয়ে শ্রী মাতাজীর সাথে আলোচনা করতেন। তাঁর বিদ্যালয়ের বন্ধুরাও তাদের জীবনের নানা বিষয়ে পরামর্শ ও সহায়তা নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে আসত।

শ্রী মাতাজী লুধিয়ানার ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ এবং লাহোরের বালক রাম মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। ঐ সময় তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং কলেজে সহপাঠীদের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪২ সালে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তাঁকে কারাবন্দি করা হয়।

Shri Mataji in Delhi, ca. 09.02.1983

১৯৪৭ সালে শ্রী মাতাজী চন্দ্রিকা প্রসাদ শ্রীবাস্তবের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, যিনি একজন উচ্চপদস্থ ভারতীয় প্রশাসক ছিলেন। তাঁর উজ্জ্বল কর্মজীবনে তিনি ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের পদ থেকে শুরু করে পরপর চারবার জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের মহাসচিবের গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেছিলেন। কল্পনা ও সাধনা তাঁদের দুই কন্যাসন্তান। সন্তানদের লালন-পালন এবং স্বামীর কর্মজীবনে সহায়তা করার পাশাপাশি শ্রী মাতাজী সবসময়ই চারপাশের জগৎ সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন।তিনি বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি, আর্থিক অবস্থান ও সামাজিক পটভূমি থেকে আসা নানা ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসতেন এবং তাদের প্রতি তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অন্ত ছিলনা। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হোক বা কোনো ট্যাক্সিচালকের পারিবারিক সমস্যা, তিনি সবসময় মনোযোগ দিয়ে শুনতেন ও বোঝার চেষ্টা করতেন। তিনি যে কোনো বৈষম্যের বিরোধিতা করতেন, দুঃস্থ মানুষদের সহায়তা করতেন, দান কার্যে নিযুক্ত থাকতেন, সংগীত ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করতেন, কৃষিকাজের উন্নতির জন্য চেষ্টা করতেন এবং এক কর্মব্যস্ত পরিবারের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সামলাতেন।

তিনি সবসময় মানব প্রকৃতির গভীরতা বোঝার চেষ্টা করতেন এবং মানুষের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছানোর সবচেয়ে ভালো উপায় কী হতে পারে, তা নিয়ে চিন্তা করতেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে এই ধরনের পরিবর্তন শুধুমাত্র নিজস্ব আভ্যন্তরীণ শক্তি কুন্ডলিনীর জাগরণের মাধ্যমে আত্ম-সাক্ষাৎকার দ্বারাই সম্ভব। এই শক্তির জাগরণ সকল মানুষের মধ্যে ঘটানোর জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।

১৯৭০ সালের ৫ই মে শ্রী মাতাজী তাঁর আধ্যাত্মিক কাজকর্ম শুরু করেন। ৪৭ বছর বয়সে তিনি একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যার মাধ্যমে বিরাট সংখ্যক মানুষকে একসাথে আত্ম-সাক্ষাৎকার প্রদান সম্ভব হয়। তিনি এমন একটি অভিজ্ঞতা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন যা তারা নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য এবং সুস্থ হতে ব্যবহার করতে পারে। অনেক ভণ্ড গুরু আছে যারা প্রকৃত সত্য সন্ধানী মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের শোষণ করে, শ্রী মাতাজী তাদের বিরোধিতা করেন এবং আত্মসাক্ষাৎকার অর্জনের শক্তি সরাসরি সত্যসন্ধানীদের হাতে তুলে দেন।

যখন তাঁর স্বামী জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থার মহাসচিব পদে আসীন হন, শ্রী মাতাজী তাঁর সাথে লন্ডনে যান। এবং সেখানে কিছু সংখ্যক মানুষকে নিয়ে তাঁর আধ্যাত্মিক কাজ শুরু করেন। তিনি যুক্তরাজ্যে সফর করেন, বক্তৃতা দেন এবং আত্মসাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা প্রদান করেন। তিনি কখনোই এসব অনুষ্ঠানের জন্য টাকা নিতেন না, বরং তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, সকল মানুষের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান এই আধ্যাত্মিক শক্তির জাগরণ তাঁদের জন্মসিদ্ধ অধিকার, তাই এর জন্য কোনো মূল্য নেয়া উচিত নয়। শ্রী মাতাজীর অসাধারণ আধ্যাত্মিক এবং মাতৃসুলভ গুণের জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি "শ্রী মাতাজী" অর্থাৎ "শ্রদ্ধেয় মাতা" রূপে সকলের কাছে সমাদৃত হন।

শ্রী মাতাজী প্রণীত আত্ম-সাক্ষাৎকার লাভের মাধ্যমে ধ্যান "সহজযোগ" নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮০ এর দশক জুড়ে শ্রী মাতাজী ক্রমাগত এবং অক্লান্তভাবে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং উত্তর আমেরিকা সফর করেন, আগ্রহী মানুষকে বিনামূল্যে এই পদ্ধতি শেখান। ১৯৯০ এর দশকে তাঁর গন্তব্য দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শ্রী মাতাজীকে সম্মানসূচক বিভিন্ন পুরস্কার ও ডক্টরেট উপাধি প্রদান করেছে।১৯৯৫ সালে তিনি বেইজিংয়ে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। ১৯৯৭ সালে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট সভাগৃহতে ক্লেস নোবেল তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়নের কথা উল্লেখ করেন। শ্রী মাতাজী ও সহজ যোগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে, তিনি একে মানবতার জন্য আশার আলো ও ন্যায়-অন্যায় বিচারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে বর্ণনা করেন।

আমার জীবন এখন মানবজাতির মঙ্গল এবং কল্যাণের জন্য সর্বোতভাবে নিবেদিত, সম্পূর্ণরূপে।

শ্রী মাতাজী বিশ্বাস করতেন যে, সহজ যোগ ধ্যানের পদ্ধতি যা আত্মসাক্ষাৎকারের মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধন করে, একমাত্র সেটাই সামাজিক পরিবর্তনের প্রকৃত ভিত্তি হয়ে উঠবে। তিনি এই অদ্বিতীয় আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে নিঃসম্বল ও অসহায় নারী ও শিশুর জন্য আশ্রয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিদ্যালয়, একটি স্বাস্থ্য ও গবেষণা কেন্দ্র, এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও কলা প্রচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক একাডেমি।

২৩শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ তারিখে ৮৭ বছর বয়সে শ্রী মাতাজী ইতালির জেনোয়াতে তাঁর পার্থিব শরীর ত্যাগ করেন।

সহজ যোগ অনুশীলনকারীদের আত্ম সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা অর্জন ও পরম যত্নে সহজ যোগ ধ্যান কেন্দ্রে অসংখ্য জীবনের পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে,১০০টির বেশী দেশে প্রতিষ্ঠিত এই ধ্যান কেন্দ্রগুলিতে বিনামূল্যে সহজ যোগ শেখানো হয়।

এবং সমুদ্রের মত, যা সকল তীরকে আঘাত করে এবং তারপর সব ঢেউ ফিরে যায় ও একটা নক্সা বুনে নেয়, সেই ভাবে আমি আমার সম্পূর্ণ জীবনকে একটি সুন্দর নক্সা রূপে দেখতে পারি এবং সেই সুন্দর বুনন কেউ ভাষায় বর্ণনা করতে পারে না।

Explore this section