সহজ যোগ

সহজ যোগ

আত্ম সাক্ষাৎকার এবং ধ্যানের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ জাগরণ

শ্রী মাতাজী নির্মলা দেবী ধ্যানাভ্যাসের পদ্ধতি দ্বারা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে আত্ম-শক্তি জাগ্রত হওয়ার উপলব্ধিকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে শ্রী মাতাজীই হলেন প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি বিপুলসংখ্যক মানুষকে একসাথে আত্ম-সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা প্রদান করেছেন। তিনি ঘোষণা করেন যে ধর্ম, জাতি, দেশ বা পরিস্থিতি নির্বিশেষে "আত্ম-সাক্ষাৎকার" লাভ করা হল সমস্ত মানুষের জন্মগত অধিকার। তিনি জোর দিয়ে আরও বলেন যে, কেউ "সত্য" বা "আত্ম-জ্ঞান" লাভ অর্থের বিনিময়ে হতে পারে না, এবং এইজন‍্যই সহজ যোগ ধ্যান কেন্দ্রে "আত্ম-সাক্ষাৎকার" সর্বদাই বিনামূল্যে প্রদান করা হয় এবং ভবিষ‍্যতেও সেটাই অব্যাহত থাকবে।

শ্রী মাতাজী আধ্যাত্মিকতার সম্পূর্ণ সচেতনতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি এই মূল্যবান বিষয়টি উপহার স্বরূপে সবার সাথে ভাগ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পিতাই শ্রী মাতাজীর এই আধ্যাত্মিক গুণকে চিনতে পেরেছিলেন এবং শ্রীমাতাজীকে সর্বপ্রথম বৃহৎ পরিসরে সাধারণ জনগণকে "আত্ম-উপলব্ধি" প্রদানের একটি উপায় খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছিলেন যেটা মানবজাতির কল‍্যাণে বৃহত্তর বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এটি শ্রী মাতাজীকে দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছর ধরে এই মানব সমাজকে পর্যবেক্ষণ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল, তিনি সাধারন মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছিলেন এবং তাদের সাথে মিশেছিলেন। মানুষের মনের বিভিন্ন চিন্তাভাবনার সমস্ত বিন্যাস এবং পরিবর্তনগুলির সাথে সম্পূর্ণরূপে পরিচিত হওয়ার পরেই তিনি তাঁর নিজের মধ্যে সহস্রার চক্র (মাথার শীর্ষে সপ্তম আধ্যাত্মিক কেন্দ্র) খোলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যা বৃহত্তর জনসমাগমের মধ‍্যে আত্ম-উপলব্ধির বিকাশ এবং সহজ যোগ ধ্যান অনুশীলনের প্রচারের জন্য তাঁর জীবনের উদ্দেশ্যকে পূরন করতে সাহায্য করেছিল।

৫ই মে, ১৯৭০ মানবজাতির আধ্যাত্মিক বিবর্তনে একটি ঐতিহাসিক দিন। আত্ম-সাক্ষাৎকার এবং সত্যিকারের ধ্যানের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শক্তি জাগরণের অধিকার আর শুধুমাত্র কিছু বিশেষ আধ্যাত্মিক গুরুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না বরং যারা উচ্চতর আত্ম-সচেতনতা অর্জনের জন্য পথ খুঁজছেন তাদের কাছেও সহজলভ্য হয়ে উঠল। যোগ অনুশীলনে শ্রী মাতাজী যে অনন্য পার্থক্য এনেছিলেন তা হল প্রথম দিন থেকেই আত্ম-শক্তি জাগরণের উপলব্ধির বাস্তবায়ন। পূর্বে এটি খুব কমই সম্ভব ছিল; কয়েক দশক না হলেও, একজন গুরুর নিবিড় নির্দেশনায় বহু বছর ধরে যোগব্যায়ামের কঠোর অনুশীলনের পরে মাত্র কিছু সংখ‍্যক লোক সেই শক্তিকে অনুভব করতে পারতেন। শ্রী মাতাজীর বক্তব‍্য অনুসারে, মানুষের সূক্ষ্মচেতনা ক্রমশ বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শীর্ষে পৌঁছেছে এবং স্বতঃস্ফূর্ত আত্ম-উপলব্ধি পাওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিপক্ক হয়েছে। এই সময়ে যদি একজন অনুমোদিত ও যোগ‍্য গুরু মানুষের মেরুদণ্ডের গোড়ায় সুপ্ত অবস্থায় থাকা সেই আদিম আধ্যাত্মিক শক্তি তথা কুণ্ডলিনী-শক্তিকে (সংস্কৃতে যার অর্থ সর্ব-ব্যাপী পরমাত্মার কুণ্ডলীকৃত শক্তি) জাগ্রত করে দিতে পারে তবে সহজেই মানুষ তার আত্ম-উপলব্ধি লাভ করতে পারে।

পরবর্তী চার দশক ধরে শ্রী মাতাজী সহজ যোগ ধ্যানের অনুশীলন প্রতিষ্ঠা করেন। যে কেউ, তাদের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, বয়স বা শিক্ষাগত পটভূমি নির্বিশেষে সহজেই এই সহজ যোগ অনুশীলন করতে পারেন। এছাড়াও, সহজ যোগ ধ‍্যানের মাধ‍্যমে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন এমন অনেকেই অনায়াসে অন্যদের আত্ম-উপলব্ধি প্রদান করতে পারেন , ঠিক যেমন একটি মোমবাতি ব‍্যবহার করে অন্য মোমবাতি জ্বালানো যায়। শ্রী মাতাজী, বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন যে অন্যদের আত্ম-উপলব্ধি দেওয়ার জন্য বা সহজ যোগের জ্ঞান শেখানোর জন্য কোনও অর্থ নেওয়া যাবে না, কারণ তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই সহজাত উপহারটি ভাগ করে নেওয়ার জন্য কখনও অর্থ নেননি। সহজ যোগ সত্যিকারের জনসমাগমে আত্ম-উপলব্ধির ভিত্তি স্থাপন করেছিল যা শ্রী মাতাজীর বাবা যখন শ্রী মাতাজী ছোট শিশু ছিলেন তখন কল্পনা করেছিলেন।

সহজ যোগ ধ্যান হল একটি সহজ অনায়াস ধ্যান পদ্ধতি যা শ্রী মাতাজী আত্মসাক্ষাৎকারের পর আধ্যাত্মিক সচেতনতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তৈরি করেছেন। 'সহজ' শব্দের অর্থ 'স্বতঃস্ফূর্ত' এবং ' যা আপনার সাথে জন্মগ্রহণ করেছে ' উভয়ই। এটি আমাদের মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম শক্তিকে (কুন্ডলিনী) জাগ্রত করে। যোগ মানে শুধুমাত্র ব্যায়াম বা শারীরিক কসরত না, বরং প্রকৃতপক্ষে এর অর্থ হল 'সংযোগ স্থাপন করা, একত্রিত হওয়া বা এক হওয়া'। যোগের লক্ষ্য হল ব্যক্তিকে নিজের আত্মার প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে সচেতন করা (সংস্কৃতে যোগ মানে সর্বব্যাপী আত্মার প্রতিফলনকে বোঝায়) এবং এই নতুন সচেতনতার সাথে সম্পূর্ণরূপে মিলন অর্জন করা। যেমন এক ফোঁটা জল সমুদ্রের সাথে মিশে যায়, তেমনি এক ব্যক্তির চেতনা সমষ্টিগত চেতনার সাথে মিশে যায়। যখন এই মিলন ঘটে, তখন কুন্ডলিনীর একত্রীকরণ শক্তি ব্যক্তি ও সমষ্টিগত উভয় পর্যায়ে ভারসাম্য ও শান্তি নিয়ে আসে।

‘সহজ যোগ’- শব্দের অর্থ আরও ভালভাবে বোঝা যাবে যদি আমরা এর সন্ধিবিচ্ছেদ করি: ‘সহ’ মানে ‘সঙ্গে’ এবং ‘জ’ মানে ‘জন্ম’, এবং ‘যোগ’ হল ‘পরমাত্মার শক্তির সাথে মিলন’। তাই ‘সহজ যোগ’ হল সেই বিশেষ ব্যবস্থা যা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে জন্মগতভাবেই বিদ্যমান, যা আমাদের ঈশ্বরের সাথে যুক্ত হতে সহায়তা করে।

YouTube player

Explore this section