সামাজিক পরিবর্তন
ভালোবাসার দায়িত্ব
শ্রী মাতাজীর এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ এবং বেড়ে ওঠা যেখানে আত্মত্যাগকেই সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হত। ফলে শ্রী মাতাজী অল্প বয়স থেকেই তাঁর জীবনকে জনসাধারণের আধ্যাত্মিক তথা সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উৎসর্গ করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে, একজন প্রখ্যাত ভারতীয় কূটনীতিকের স্ত্রী হিসাবে এবং দুই কন্যার মা হিসেবে তাঁর ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও, তিনি তাঁর চারপাশের জগতের প্রতি কল্যাণকামী আগ্রহ সর্বদা বজায় রেখেছিলেন। ১৯৬১ সালে, শ্রী মাতাজী তরুণদের মধ্যে জাতীয়, সামাজিক এবং নৈতিক মূল্যবোধকে উৎসাহিত করার জন্য 'ইয়ুথ সোসাইটি ফর ফিল্মস' চালু করেছিলেন। তিনি মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন।
সহজ যোগ ধ্যানের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করার জন্য, তিনি বিভিন্ন দেশ, সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন আর্থসামাজিক স্তরে থাকা মানুষের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং তাদের সাথে আগ্রহ ও আন্তরিকতার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, সমস্ত সমস্যাই মানুষের অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিক সত্ত্বার বিকৃতি ও জটিলতা থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং একে সহজেই আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। অভ্যন্তরীণ রূপান্তর, যা সামাজিক রূপান্তরের চাবিকাঠি, তা শ্রী মাতাজী দ্বারা প্রস্থাপিত সমস্ত বৈশ্বিক মানবসেবা মূলক প্রতিষ্ঠানগুলির ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে কাজ করে।
তিনি অসহায় নারী এবং অনাথ শিশুদের জন্য বিশ্ব নির্মলা প্রেম আশ্রমের মতো দাতব্য সংস্থা তৈরি করেছেন, আলোকিত শিক্ষার প্রচারে আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপন করেছেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং চারুকলা প্রচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন এবং আরও অনেক কিছু। এই সমস্ত প্রচেষ্টা তাঁর বিশ্বব্যাপী আধ্যাত্মিক রূপান্তরের কাজের পরিপূরক।
একবিংশ শতাব্দী আমাদের বহুমুখী দ্বন্দ্বের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে, যার প্রতিক্রিয়াগুলি আগামীকালের সমাজের নতুন নিয়মগুলিকে সংজ্ঞায়িত করবে এবং গঠন করবে। বিশ্বব্যাপী মানুষ এই দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্য অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে, তা বৈশ্বিক মহামারী, জলবায়ু পরিবর্তন, আর্থ-সামাজিক সমস্যা, সাংস্কৃতিক সংঘাত, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি যাই হোক না কেন। এই সমস্ত কিছু এই পৃথিবীতে আমাদের ভবিষ্যতকে নির্ধারণ করবে।
সমাজ আজ যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয় তার অনেকগুলিই লোভ এবং বস্তুবাদের কারণে। শ্রী মাতাজী ব্যাখ্যা করেছেন যে বস্তুবাদ হল বস্তুর প্রতি একটি ভুল মনোভাব এবং সেই বস্তুর নিজস্ব সৌন্দর্য রয়েছে যা আমাদের আনন্দ দেয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা যদি একটি সুন্দর শিল্পকর্ম দেখি, আমরা এটির প্রশংসা করতে পারি, কিন্তু আমাদের এটিকে অধিকার করার দরকার নেই। অথবা যদি আমরা আমাদের ভালবাসার প্রকাশ হিসাবে কাউকে উপহার দিই, আমরা বস্তুটিকে উপযুক্ত উপায়ে ব্যবহার করি এবং সেই বস্তুকে কুক্ষিগত করা এবং সেটির মালিকানার ক্ষণস্থায়ী আনন্দের বাইরে সত্যিকারের তৃপ্তি অনুভব করি।
কুন্ডলিনী জাগরণের মাধ্যমে আত্ম-সাক্ষাৎকারের পর যখন আমাদের সূক্ষ্ম দেহের তৃতীয় কেন্দ্র, যা নাভি চক্র নামে পরিচিত, আলোকিত হয়, তখন আমরা লোভ এবং অধিকারের নেতিবাচক প্রবণতা থেকে মুক্ত হই এবং সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্টি বোধ করি। আমরা বস্তুর আধ্যাত্মিক মূল্য দেখি। এছাড়া প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি বস্তু এমনকি হস্তনির্মিত সুন্দর কারুশিল্প এবং চিত্র থেকে নির্গত চৈতন্য শক্তিকে অনুভব করি। শ্রী মাতাজী এই ধরনের ঘটনার জন্য বস্তুর অন্তঃস্থিত সূক্ষ্ম চৈতন্য শক্তিকে চিহ্নিত করেছেন যা আত্ম-উপলব্ধির পরে অনুভব করা যায়।
মজার বিষয় হল আমাদের সূক্ষ্ম দেহ যন্ত্রের ২য় কেন্দ্র, যা স্বাধিস্ঠান চক্র নামে পরিচিত, আমাদের সৃজনশীলতার বোধকে বাড়িয়ে তোলে, যা আমাদের কেবল অন্যের সৃজনশীল কাজের প্রশংসা করতেই সক্ষম করে না, বরং প্রায়শই আমাদের নিজের সহজাত সৃজনশীল সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করতে সক্ষম করে। অনেক সহজ যোগ ধ্যান অনুশীলনকারী তাদের নিজেদের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশে বিস্মিত হয়, যার সবকটিই বিশুদ্ধ অনুপ্রেরণা এবং অন্তর্দৃষ্টি হিসাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে।
শ্রী মাতাজী এই সুন্দর সূক্ষ্ম গুণাবলীর প্রকাশকে শুধুমাত্র ব্যক্তি স্বার্থে নয়, বরং একটি সমষ্টিগত শক্তি হিসেবেও দেখেছিলেন যা সমাজে প্রকাশ পেতে পারে এবং মানবতার গতিপথকে আত্ম-হননের পথ থেকে সরিয়ে পৃথিবীকে সৃজনশীল ও সুন্দর জীবনের দিকে অগ্রসর করতে পারে।
শ্রী মাতাজীর মানবতার প্রতি স্নেহ এবং করুণাই ছিল তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। তিনি যা করেছেন তা শুধুমাত্র "কাজ" হিসাবে উল্লেখ করেননি, বরং ভালবাসার শ্রম যা তিনি পুরোপুরি উপভোগ করেছিলেন।